অস্থির পৃথিবীতে কেন ভূমিকম্প
শুভঙ্কর গাঙ্গুলি
ভয়ংকর ভূমিকম্প ধ্বংস করে দিয়েছে টার্কি সিরিয়া সংলগ্ন এক বিশাল এলাকা। ৩৫,০০০ মানুষ-এর মৃত্যু। হতাহতের সংখ্যা গুণে শেষ হচ্ছে না। পৃথিবীর বহু দেশ উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
কিন্তু টিভির পর্দায় দেখা একটা দৃশ্য ভুলতে পারছি না। চার কি তিন বছরের দিদি ১০ মাসের বোনের কান্না থামাতে নিজের স্তন দান করছে বোনকে। দুটি শিশুই আজ অনাথ। অসহায়। মা-বাবা হারানো। কী ভবিষ্যৎ ওদের?
কথায় আছে ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য। কার মঙ্গলের জন্যে? এই প্রশ্নটাই মাথায় ঘুরছে। ভগবান আছে কি নেই সেই প্রশ্নে না গিয়ে বলা যায় ভগবান অন্তত ভূমিকম্পর জন্যে দায়ী নয়।
ভূমিকম্পের কারণ ও মানুষের ভূমিকা আমায় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ভগবানের ইচ্ছা হলে সারা পৃথিবীতে একসাথে ভূমিকম্প হতে পারে। কেউ অনাথ হয় না। তাই জানতে হলে জানতে হয় প্রকৃতির রহস্য। বিজ্ঞান। না হলে ভগবানের নিজস্থান কেদারনাথ বন্যায় ভেসে যেত না। প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক খুব পবিত্র। প্রকৃতি বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। প্রকৃতি ধ্বংস হলে আমরাও ধ্বংস হব।
ভূমিকম্প কোথায় বেশি?
ভূমিকম্পের প্রকোপ পৃথিবীতে সর্বত্র সমান না। ভূমিকম্পের ফলে যে অগ্নি উৎপাদন, সুনামি, ভূমিধস হয় তারও প্রকোপ বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন। যেসমস্ত দেশে প্রায়শই ভূমিকম্প হয় ও প্রবল হয় সেগুলো হলো ইতালি গ্রিস, তুরস্ক, ইরান, ভারত, ইন্দো-চায়না, ইন্দোনেশিয়া, জাপান প্রভৃতি।
লক্ষ্য করলে দেখা যায় প্রধানতঃ টারটিয়ারি (tertiary) যুগের নবীন ভঙ্গুর পর্বতমালা অঞ্চলে এই ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলো অবস্থিত।
তীব্রতা ও শক্তি
ভূমিকম্পের তীব্রতা বা Intensity ও শক্তি (Energy) কিন্তু এক বিষয় না। পদার্থবিজ্ঞান-এর মতে Richter Beno Gutenberg তত্ত্ব হিসাব করে ভূমিকম্পের Intensity (M) ও ভূমিকম্প কেন্দ্রে যে শক্তি (E) নির্গত হয় তার মধ্যে সম্পর্ক logE=K+1.5M সমীকরণ দিয়ে বোঝানো হয়।
K-এর মান ৯ থেকে ১২-র মধ্যে থাকে। ভূমিকম্পের তীব্রতার মাত্রা অনুযায়ী Richter Scale-এ ৩.৪-এর কম থেকে ৮-এর বেশি ধরা হয়। সেই তীব্রতা যত বেশি হয় জনগোষ্ঠীর উপর তার প্রভাব তত বেশি।
ভূত্বকের গভীরে পাত
ভূবিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর ভূত্বক কতগুলো শক্ত ও কঠিন খণ্ডে বিভক্ত। এগুলোকে পাত বলা হয়। পিচ্ছিল asthenosphere-এর উপর পাতগুলো খুব ধীর গতিতে চলে। পাতগুলো কখনও তাদের সীমানা বরাবর একে অপরের দিকে, উল্টোদিকে বা পাশাপাশি ঘর্ষণ বা friction করতে করতে এগিয়ে যায়। এর ফলে ভূমিকম্প, সমুদ্র খাত, ভঙ্গিল পর্বত ইত্যাদি সৃষ্টি হয়।
পৃথিবীতে সাতটি বড় পাত হল ইউরেশিও পাত, ভারতীয় পাত, উত্তর আমেরিকা পাত, প্রশান্ত মহাসাগরীয় পাত, আফ্রিকা পাত এবং অ্যান্টার্কটিকা পাত।
অনেক সময় দুটো পাত পরস্পরের দিকে অগ্রসর হয়ে সংঘর্ষ ঘটায়। ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। কিছু ক্ষেত্রে দুটো পাত সংঘর্ষ করে এগিয়ে যেতে থাকে। ফলে ভূমিকম্প, fault তৈরি হয়।
এই সীমান্ত পাতের ধ্বংস বা সৃষ্টি কিছুই হয় না। একে নিরপেক্ষ সীমানা বলে। San Andreas Fault এরকমই একটি সীমানার উদাহরণ। এই fault বরাবর প্রশান্ত মহাসাগরীয় পাত উত্তরে ও উত্তর আমেরিকা পাত দক্ষিণে সরছে।
ভূমিকম্পের ফোকাস
ভূমিত্বকের নিচে যে স্থান থেকে ভূমিকম্পের উদ্ভব হয় তাকে ফোকাস বলে। কেন্দ্র থেকে ঠিক আড়াআড়ি বা vertically যে বিন্দুতে প্রথম কম্পন পৌঁছায় তাকে epicentre বলে। ভূমিকম্পের ফলে উৎপাদিত শক্তি পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে তরঙ্গের আকারে, পুকুরে ঢিল ফেললে যেরকম হয় সেভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
মুনাফার লোভে বাড়ছে ক্ষতি
এ তো গেল প্রকৃতির রহস্য। বিজ্ঞানের কথা। আমাদের লোভ কি প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে সাহায্য করছে না?
ধরা যাক তুরস্কের ঘটনা। সেখানকার অসহায় সর্বস্ব হারানো মানুষের কথা। 'ওয়ার্ল্ড সোশালিস্ট ফোরাম'-এর সংবাদদাতা সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। অভিজ্ঞতা বলছে, এই ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির জন্যে প্রকৃতি যত না দায়ী তার থেকে অনেক বেশি দায়ী মানুষের লোভ। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর লোভ।
ভূমিকম্প প্রভাবিত অঞ্চলে তুরস্কের অবস্থান। কিন্তু সেখানে নির্মাণ কোম্পানিগুলো বড় বড় উঁচু বাড়ি বানিয়েছে ভূমিকম্পের প্রতিরোধ আইন না মেনে। সরকার নির্বাক থেকেছে।
ভূমিকম্প হতো। জাপানে প্রায়ই হয়। কিন্তু মানুষের এই দুর্দশা হয় না। শিশু অনাথ হয় না। তুরস্কের সরকার উঠতি মুনাফাখোরের পক্ষ নিয়ে মানুষের জীবন কেড়েছে।
Adanar অন্তর্ভুক্ত cucurova জেলায় নিম্নমানের বিল্ডিং নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করায় ১৩টি apartments ভেঙে পড়েছে। ৩৭৮ জনের প্রাণ গেছে। মাত্র ৩৩ জনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এই অবস্থায় নিজেদের দোষ ও মানুষের রোষকে ঘুরিয়ে দিতে শাসক বিভাজনের রাজনীতি করছে। চুরি, ডাকাতির দায় চাপিয়ে দিচ্ছে সিরিয়ার refugees-দের উপর। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষকে, তাদের একতাকে ভাঙতে পারছে না।
প্রফেসর মুস্তাফা এরদিকের মতে, ১২,১৪১টি appartment ধ্বংস হয়েছে। তাঁর মতে বিজ্ঞানের আভাস অনুযায়ী ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু এই হারে জীবন যেতে পারে না। Deccan Heralds থেকে যা পাওয়া যায় যে ইস্পাত বা steel রডের ব্যবহার হয় ভূমিকম্প প্রতিরোধের জন্য তা ছিলো নিম্নমানের। প্রশাসন সব জেনেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কাগজে কলমে সব ঠিক। কিন্তু আধিকারিক, শাসকশ্রেণির রাজনীতিবিদ ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর লোভ আজ এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
California-র একটি বৈজ্ঞানিক সংস্থার মতে, প্রচুর পরিমাণে petrolium উত্তোলন, মাটির তলার জল উত্তোলন এবং যত্রতত্র কংক্রিটের নির্মাণ প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর ব্যপারে এখন আমাদের স্কুলের শিশুরাও জানে।
হিমালয়ে বেপরোয়া নির্মাণ
আমরা আমাদের দেশে হিমালয় অঞ্চলে দেখতে পাচ্ছি লোভের ফলাফল। জোশিমঠ আজ মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র শাসকশ্রেণির লোভ চরিতার্থ করতে প্রকৃতির eco-system ধ্বংস করে চলেছে। বিন্ধ্য পর্বতমালা আজ নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে। পশ্চিমবঙ্গের ডেউচা পাচামী শুধুমাত্র প্রকৃতিকেই ধ্বংস করে ছাড়বে না। আদিবাসী, বসতি সব নিশ্চিহ্ন হবে। তাদের সংস্কৃতি, সভ্যতা, জমি-জায়গা, রুটি-রুজি সব হারাবে।
লোভের সমাজে লোভের কাছে আত্মসমর্পণ করতে কি বাধ্য হব আমরা। নাকি প্রকৃতিকে বাঁচাতে, নিজেদের অস্তিত্বরক্ষায় রুখে দাঁড়াবো, এটিই বড় প্রশ্ন।