"মুনাফার তাড়নায় বসবাসের অযোগ্য হচ্ছে শহর"
সাক্ষাৎকারঃ টিকেন্দর সিং পানোয়ার
তারিখঃ **/**/****
[
সিমলা পৌরনিগমের প্রাক্তন ডেপুটি মেয়র টিকেন্দর সিং পানোয়ার কলকাতায় এসেছিলেন 'পশ্চিমবঙ্গ বস্তি উন্নয়ন সমিতি'র রাজ্য সম্মেলনে অংশ নিতে। শহরে সকলের অধিকারের পক্ষে আন্দোলনের জাতীয় স্তরের সংগঠক তিনি। সেই ফাঁকে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছে 'সংযোগ ডট কম'।
বিশ্বায়নের সময়ে নগরায়নের নীতি মুনাফাসর্বস্ব হয়ে পড়ছে কিভাবে, ব্যাখ্যা করেছেন টিকেন্দর। নিম্নবিত্ত, দরিদ্রদের ন্যূনতম নাগরিক পরিষেবা কেড়ে নেওয়ার পরিকল্পনা প্রসঙ্গে মত জানিয়েছেন তিনি। বিকল্পের দিকে পথ হাঁটা কিভাবে, জানিয়েছেন সেই প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য। নাগরিককে পরিকল্পনা তৈরির কাজে শামিল করার পক্ষে সওয়াল করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভঙ্কর গাঙ্গুলি।]
______________________________
সংযোগঃ নতুন পর্যায়ের নগরায়ন চলছে সারা দেশে বাস্তবে সারা বিশ্বেই এই প্রক্রিয়া চালু রয়েছে। ফলাফল কী হচ্ছে নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনের ক্ষেত্রে?
টিকেন্দরঃ এটি অবশ্যই লক্ষ্য করার মতো বিষয় হয়ে উঠেছে ১৯৯০ সালের পর থেকে নয়া উদারবাদের যুগে আমাদের দেশে শহরগুলোকে 'ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিট' হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। নগর পরিকল্পনার দিকে তাকালে দেখা যাবে শহরগুলোকে একেকটি 'শিল্পোদ্যোগী ইউনিট' ধরা হচ্ছে।
সংযোগঃ তাতে সমস্যা কি হচ্ছে?
টিকেন্দরঃ সমস্যা হলো এক দিকে বহুতল মাথা তুলছে বহু বহু সংখ্যায়, শহরের আকাশরেখা বদলে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বস্তিবাসী মানুষের সংখ্যা, শহরে তাঁদের আবাসের ব্যবস্থা নেই। জমির প্রতি ইঞ্চিতে মুনাফার মনোভাব শহরকে বসবাসের অযোগ্য করে দিচ্ছে। পরিবেশবিধি মানা হচ্ছে না। নগর পরিকল্পনায় মানুষকেও যুক্ত করা হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে এদেশে, বিশ্বেও শহরগুলো জলে ভাসছে প্রতিবছর রোগ ব্যারামের ঘাঁটি হয়ে উঠছে।
সংযোগঃ নগর পরিকল্পনার কথা বলছেন। কিভাবে বদলে গেল নগর পরিকল্পনার ধরন?
টিকেন্দরঃ স্বাধীনতার পরের পর্ব যদি বিচার করেন, যে পর্বকে আমরা মোটামুটি ভাবে 'নেহেরুভিয়ান মডেল' বলতে পারি, সেখানে নগর উন্নয়নে রাষ্ট্রই ছিল প্রধান বিনিয়োগকারী। সেই শহরে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, ধনী, গরিবের ফারাক থাকলেও পাশাপাশি বসবাসের উপায় ছিল। ১৯৯১ সালের পর নগর উন্নয়নে নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায় বেসরকারি পুঁজি। যেমন ধরুন দিল্লির কাছের শহর গুরগাঁওয়ে ২২টি চোখ ধাঁধানো বেসরকারি শপিং মল রয়েছে। অথচ গোটা শহরে সরকারি পরিবহণ চোখে পড়বে না। বিভিন্ন শহরেই জলবিদ্যুৎ নিকাশী সর্বত্র বেসরকারি ঠিকাদারদের হাতে তুলে দেওয়াই মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে রাখা ভালো নেহেরুর মডেলেও নগর পরিকল্পনায় মানুষের অংশগ্রহণের বিশেষ ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু আজকের পর্বে তার ন্যূনতম সুযোগ তুলে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের পর নগর পরিকল্পনায় গরিব এবং নিম্নবিত্ত মানুষের কোনও জায়গা আর নেই।
সংযোগঃ সাধারণের নগর হলে পরিকল্পনায় কোন কোন বিষয় থাকা উচিত ছিল?
টিকেন্দরঃ যেমন ধরুন বহু মানুষকে পায়ে হেঁটে চলতে হয়। তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা থাকার দরকার ছিল। সাইকেল চলাচলের আলাদা রাস্তা থাকার দরকার ছিল। দেখবেন চার হাজার কোটি প্রতি কিলোমিটারে খরচ মেট্রোর, তা তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু সাইকেল লেন তৈরি করা হয় না। কিছুদিন আগে 'জাতীয় পরিবেশ ট্রাইবুনাল' পরিবেশবিধি না মানায় পশ্চিমবঙ্গকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ফাইন করেছে। এটা অত্যন্ত লজ্জার। পাশাপাশি দেখা প্রয়োজন যে কেন পশ্চিমবঙ্গ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পিছিয়ে পড়ছে। তার কারণ অপ্রয়োজনে পুঁজি নিবিড় প্রযুক্তির ওপরে ভরসা করা হচ্ছে। সেইসঙ্গে তুলে দেওয়া হচ্ছে স্বচ্ছতার বিধি।
সংযোগঃ আপনি বলছিলেন নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষের আর জায়গা থাকছে না শহরে। গরিবকে আশ্রয় নিতে হচ্ছে বস্তিতে। বস্তির আয়তন বাড়ছে। আমরা দেখছি উচ্ছেদেরও পরিকল্পনা গভীর হচ্ছে। জীবিকার সংকট হচ্ছে। বিকল্প কী?
টিকেন্দরঃ বিকল্পের ভাবনায় এগুলোর আগে শহরে জীবিকার পরিবর্তনের একটি দিক দেখা গুরুত্বপূর্ণ। শহর নয়া উদারবাদের আগে ছিল শিল্প এবং পরিষেবার কেন্দ্র। কলকাতা, মুম্বাই বা দিল্লিতে বিভিন্ন কারখানা ছিল। মুম্বাইয়ে কাপড়ের মিল ছিল। কাজের খোঁজে আসা বহু মানুষ বস্তিতে থাকতেন। কিন্তু তাঁদের জীবিকার নির্দিষ্ট সংস্থান ছিল। এখন শহরগুলো থেকে সব কারখানা তুলে দেওয়া হচ্ছে। কেবল পরিষেবার কেন্দ্র কিছু থাকছে। ফলে অদক্ষ শ্রমিকের স্থায়ী কাজ পাওয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে। কেবল মুম্বাইয়ে প্রায় ২ লক্ষ কাপড়ের মিল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নগর পরিকল্পনায় যে এজেন্সিগুলো প্রধান দায়িত্বে, যেমন দিল্লির ক্ষেত্রে 'দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি', তারা কোনো নির্বাচিত সংস্থা নয়। স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রশ্নের জবাব দেওয়া তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। এমনকি রাজ্যের সরকারকে এড়িয়ে কাজ করার এক্তিয়ার তাদের দেওয়া হয়েছে। নগর পরিকল্পনা থেকে মানুষকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে যারা শহরের বিভিন্ন আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন, যেমন বস্তিবাসীদের আন্দোলন, সেই সংগঠকদের কাছে পরিকল্পনায় মানুষকে যুক্ত করার দাবি গুরুত্বপূর্ণ। তা বিকল্পের দিকে এগোনোর রাস্তা খুলে দিতে পারে।
সংযোগঃ বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে নীতি ছিল মানুষের সশক্তিকরণ। ৭৪তম সংবিধান সংশোধন, পঞ্চায়েত ও পৌরসভার হাতে ক্ষমতা, পশ্চিমবঙ্গের মডেল দেখে করা হয়েছে। এই সময়ে দেশে বা বিশ্বে মানুষকে যুক্ত করে পরিকল্পনার মডেল কোথায়?
টিকেন্দরঃ আপনি বার্সেলোনার দিকে দেখতে পারেন। বাসিন্দাদেরই যুক্ত করা হয়েছিল তথ্য সংগ্রহের কাজে। তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা হয়েছিল 'আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স' বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে সরকারি পরিষেবার উদ্যোগ ছিল। যেমন বহুজাতিক 'উবর'কে পাল্লা দিতে নগর প্রশাসন নিজস্ব তথ্যপ্রযুক্তি পরিকাঠামোয় অ্যাপ ক্যাব পরিষেবা চালু করেছে। এমন উদ্যোগ কেরালাতেও নেওয়া হচ্ছে। খেয়াল করে দেখুন 'উবর'-এর মতো সংস্থা নিজেদের কমিশন বাবদ ভাড়ার ৩৫% পর্যন্ত কেটে নিচ্ছে। শহরে বহুজাতিকদের হাতে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ার কারণে অসমতা বাড়ছে। শহর বসবাসের অযোগ্য হচ্ছে। মুনাফার তাড়নায় জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা হিসেবেই রাখা হচ্ছে না। এর একটি ফলাফল হলো, প্রতি বছর প্রতিটি শহর জলে ভাসছে। বস্তি আন্দোলনের যাঁরা সংগঠক, তাঁরাও শহরের নাগরিক সমাজের নেতা। ফলে বিকল্প পরিকল্পনায় মানুষকে শামিল করার লড়াইয়ে তাঁদের ভূমিকা রয়েছে। বৃহৎ পুঁজির দখলদারি প্রতিরোধে একমাত্র পথ গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ।